সামিয়ান হাসান, বিয়ানীবাজার :: নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৯শ মে অনুষ্ঠিত হবে বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিতব্য বহুল কাঙ্ক্ষিত এই নির্বাচনে ভোটারদের আস্থা ফেরাতে কৌশলী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে দলীয় প্রতীক ছাড়াই অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কেবল দলীয় প্রতীকই নয়, একক প্রার্থী বাছাইয়েও তারা আগ্রহী নয়।
নির্বাচনী রাজনীতির এমন কৌশলী প্রেক্ষাপটে বিয়ানীবাজারে আওয়ামী লীগ থেকে বেশ কয়েকজন প্রার্থী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবেন- এটা প্রায় নিশ্চিত। এরই মধ্যে হেভিওয়েট কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যানার-ফেস্টুন টাঙ্গিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি মাঠ গোছানোর কাজে সময় দিচ্ছেন। অন্যান্য প্রার্থীরা এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি প্রকাশ্যে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে এলাকায় সময় দিচ্ছেন। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী নির্বাচন করবেন না বলে সূত্র জানায়। জামায়াতে ইসলামি একক প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনের জন্য অনেকটা ওপেন সিক্রেট গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য ইসলামি দল থেকে কোনো প্রার্থীর নাম নজরে আসেনি। শুধু তাই নয়, আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীও।
বিয়ানীবাজারে প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলটি আওয়ামী লীগকে নানা সংকটে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সে সংকটের আঁচ ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যখন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করা শুরু হয়েছে, মূলত তখন থেকেই সংকট দানা বেঁধেছে। সেটা কাটিয়ে না উঠতেই আবার আগের পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ায় সংকট না কমে বরং আরও ঘনীভূত হবে।
মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার ঘোষণায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে নেতিবাচক অনুভূতির কথা শোনা যাচ্ছে। দলীয় প্রতীক এবং প্রার্থীহীন নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে কোন্দল বাড়বে- এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় শৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আহমদ হোসেন বাবুল বলেন, এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো লক্ষণ। নিজেকে যাচাই করার সুযোগ।
তবে অপর সহ-সভাপতি ছালেহ আহমদ বাবুল বলেন, দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচন দলের জন্য ‘উপজ্বালা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখন প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচন করার সিদ্ধান্তও একই ‘উপজ্বালার’ মুখোমুখি ফেলে দেবে দলকে।
উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ‘উপজ্বালার’ আশঙ্কার কথা তুলে ধরে মোল্লাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের আইন মূলত ওলট-পালট করে দিয়েছে তৃণমূলের রাজনীতি। এতে করে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খান ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, স্থানীয়ভাবে একক প্রার্থী দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হবে। তবে প্রতীক না থাকায় ব্যাক্তিগত ইমেজ এবং কর্মীবান্ধব নেতাকেই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বেছে নেবেন। নেতাকর্মীরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে কাজ করবেন। সেক্ষেত্রে দলীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।
বিয়ানীবাজারে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আতাউর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আওয়াল, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ জাকির হোসেন ও আব্দুল বারী, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবুল কাশেম পল্লব (বর্তমান চেয়ারম্যান) ও সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন নির্বাচন করতে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদ্বন্ধিতায় আগ্রহী উল্লেখিত প্রার্থীদের কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।
বিএনপি থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন উপজেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আহমদ রেজা। পোস্টার-ব্যানারে প্রচারণার পাশাপাশি নিজ বাড়িতে ইফতার মাহফিল করে প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামি প্রার্থী হিসেবে তাদের উপজেলা আমীর মাওলানা ফয়জুল ইসলামের নাম ঘোষণা করেছে। তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে নির্বাচনী মতবিনিময়ও করছে। প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ওয়ার্ডভিত্তিক নানা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। ফয়জুল ইসলাম জানান, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কেন্দ্র থেকে তাকে সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে।
এছাড়া স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের খন্ডকালীন প্রভাষক, সাংবাদিক মো. জহির উদ্দিন ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী মো. জাকির হোসেন সুমন। তারাও নির্বাচনী মাঠ গোছাতে কাজ করছেন।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রভাষক জহির উদ্দিন বলেন, আমি শিক্ষকতা পেশায় থাকার ফলে আমার সমর্থনে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী নির্বাচনের আগে মাঠে নামবে এবং প্রকাশ্যে তারা মাঠে কাজ করবে। তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা আমার নির্বাচনী মাঠে বড় ভূমিকা রাখবে। আমার পক্ষে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের গণজোয়ার সৃষ্টি হবে এবং আমি বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করবো।
উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবুল কাশেম পল্লব বলেন, দলীয় সভানেত্রী নির্বাচনী মাঠে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা এবং যোগ্যতা দেখার জন্য উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই তৃণমূলের কর্মীরা তাদের পছন্দের যোগ্য প্রার্থীর পক্ষে মাঠে কাজ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সাংগঠনিকভাবে কোনো বাধার সৃষ্টি হবে না। বিগত নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকার পরেও আমাকে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন। আমি তাদের সেই বিশ্বাসের মূল্যায়ন দিয়ে দিন-রাত তাদের সেবা করার চেষ্টা করছি। আমি সেবক হয়ে তাদের পাশে ছিলাম বলেই ভোটাররা আমাকে নির্বাচন করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাদের কথার মূল্যায়ন দিতে গিয়েই আগামী নির্বাচনে আমি প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আহমদ রেজা বলেন, এলাকার জনগণ এবং তৃণমূলের কর্মীরা নির্বাচন করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাই মানসিকভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শেষ পর্যন্ত আমি নির্বাচন করবো।
দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশা করছি দল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবে। দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে আমি প্রয়োজনে দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেবো।
উল্লেখ্য, বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে যুবলীগ নেতা সোহেল আহমদ রাশেদ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা খালেদুর রহমান, আশরাফুল হক রুনু, জমিয়তের রেদওয়ান আহমদ প্রমুখের নাম শোনা যাচ্ছে। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও এ পর্যন্ত ৪ জনের প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়েছে। বিয়ানীবাজারের ৮৯টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply